মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৪

নিখোঁজ শহীদুলকে নিয়ে সাইবার দুনিয়ায় তোলপাড়

অপহৃত শহীদুল ; ফাইল ফটো
শহীদুল! ফুটফুটে এক বাঙালি শিশু। সে আজ প্রায় দুই মাস ধরে নিখোঁজ। পরিবারের অভিযোগ, তাকে অপহরন করেছে উপজাতি স্বশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ। গত কিছুদিন আগেও নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার মত আরেকটি অপহরনের ঘটনা ঘটেছে পাহাড়ে। তবে এটি ছিল ‘হাই-প্রোফাইল’ অপহরন। উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে অপহৃত হয়েছিল উপজাতি সংগীত শিল্পী সৌরভ চাকমা টিনটিন ও তার বন্ধু। কিন্তু ৫ দিনের মাথায় তাদের উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। উল্লেখ্য, সৌরভ চাকমা পার্বত্য অঞ্চলের বেশ নামজাদা পরিবারের সন্তান। তার বাবা পিডিবি’র চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাবেক প্রধান, তার শ্বশুর তুষার কান্তি চাকমা সেনাবাহিনীতে কর্মরত একজন ব্রিগেডিয়ার, তার চাচা জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি’র সহ-প্রজেক্ট ডিরেক্টর ও রাঙামাটির অন্যতম ধর্ণাঢ্য ব্যাক্তি, তিনি চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের আগের স্ত্রীর ভাই। সুতরাং এত গুরুত্বপূর্ন পরিবার সমূহের আত্নীয় এই গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তি ও তার বন্ধুকে ৫ দিনের মাথায় উদ্ধার করে ফেলে সেনাবাহিনী। সাইবার দুনিয়ায় তোলপাড় এ নিয়ে। সবার প্রশ্ন, সৌরভ চাকমা ও তার বন্ধুকে ৫ দিনের মাথায় উদ্ধার করা গেলেও, ২ মাস আগে খাগড়াছড়ির পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে অপহৃত হওয়া দরিদ্র পরিবারের সন্তান শিশু শহীদুলকে উদ্ধারে কোন পদক্ষেপ কেন নেওয়া হচ্ছে না, এমনকি তার অপহরন রহস্যের কোন কিনারা কেন হচ্ছে না?

ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাকঃ ঘটনার শুরু খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে নিহত সবিতা চাকমা নামের এক উপজাতি নারীকে নিয়ে।
সবিতা চাকমার লাশ কমলছড়ির চর এলাকার সবজিক্ষেত থেকে উদ্ধার করা হয়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারী তিনি নিহত হন। তিনি কেন নিহত হয়েছেন, এটা নিয়ে আজও ধোঁয়াশা থাকলেও, সবসময়ের মত উপজাতি সংগঠনগুলো প্রথম থেকেই একতরফাভাবে দোষ দিতে থাকে বাঙালিদের। এক্ষেত্রে তারা দায়ী করে কোন একটি যানবাহনের বাঙালি হেলপারকে, যে না কি ধর্ষন করে খুন করে রেখে যায় সবিতাকে। যদিও সবিতা চাকমা যেখানে নিহত হয়েছেন, সেটি সম্পূর্ণই পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকা এবং নিকটস্থ সড়ক থেকে বহু দূরে। ময়নাতদন্তে বের হয়ে যায় গোমর। ময়নাতদন্তে রিপোর্টে দেখা যায়, সবিতা চাকমাকে ধর্ষন করা হয়নি, তার তখন পিরিয়ড চলছিল, তাই অতিরিক্ত পোষাক যথাস্থানেই ছিল। এ নিয়ে পার্বত্য নিউজেই সর্বপ্রথম সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এদিকে তখনও বাঙালিদের দায়ী করে সর্বত্র মিছিল মিটিং অব্যাহত রেখেছিল পাহাড়ি বিভিন্ন সংগঠন। পাহাড়ি স্বশস্ত্র ও অনিবন্ধিত সংগঠন ইউপিডিএফ পাহাড়ের প্রত্যেকটি উপজেলায় এ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। এমনকি শাহবাগেও তারা মানববন্ধন করে। তখন এগিয়ে আসে বাঙালি সংগঠন বাঙালি ছাত্রপরিষদ। তারা সবিতা চাকমাকে হত্যার পেছনে বাঙালিদের দায়ী করার প্রতিবাদে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি সদরে আয়োজন করে মানববন্ধনের। কিন্তু মানববন্ধন করে ফেরার পথে বেশ কয়েকজন নিরীহ বাঙালিকে অতর্কিতে হামলা করে পাহাড়ি উগ্র যুবকেরা। এতে ঘটনাস্থলেই বেশ কয়েকজন বাঙালি গুরুতর আহত হয়। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে আক্রমনাত্নক হয়ে উঠে স্থানীয় বাঙালিরাও। কিন্তু প্রশাসন ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের অনুরোধে শান্ত থাকে তারা। কিন্তু হঠাৎ করেই খবর বের হয় বাঙালি শিশু শহীদুলকে অপহরন করেছে
শহীদুলকে খুজতে গেলে আহত ৮ বাঙালির চারজন
ইউপিডিএফ। গুটিকয়েক কিছু বাঙালি শহীদুলকে খুঁজতে পাহাড়ি এলাকায় গেলে সেখানে সহযোগীতা না করে, উল্টো সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়া হয়। একজন বাঙালির চোখ উপড়ে ফেলে, অপর আরেকজনের রগ কেটে দেওয়া হয়। তখন ‘Jummaland’ ‘cht voice’ নামের কিছু ফেইসবুক পেইজ রটানো হয়, বাঙালিরা পাহাড়িদের বাড়িতে হামলা করতে এসেছে। একইসাথে উস্কানি দেয়া হয় পাহাড়িদের। সিএইচটি কমিশন সহ বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন সবিতা চাকমাকে নিয়ে বিবৃতি দিলেও, অপহৃত শিশু শহীদুলকে নিয়ে আজও কোন বিবৃতি দেয়ার প্রয়োজনটুকু মনে করেনি। ঘটনার পরপর সেনাবাহিনী, পুলিশ শহীদুলের পরিবারকে তাকে উদ্ধারের আশ্বাস দিলেও আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি কোন আশ্বাস। এমনকি নামেমাত্র মামলা নেওয়া হয় অপহরনের ১৫ দিন পর। কোন ধরণের সিরিয়াস অভিযান পরিচালনা করা হয়নি আজও। ঘটনার সাথে জড়িত রুবেল চাকমা, বিজ্জুকা চাকমা, মিন্টু চাকমারা আছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শহীদুল মরে গেছে না বেঁচে আছে, কেউই জানে না খবর।

সৌরভ চাকমা বনাম শহীদুলঃ অপহরন হওয়ার প্রায় ২ মাস অতিক্রান্ত হলেও আজও কোন ধরণের খোঁজ মেলেনি শহীদুলের। প্রশাসন নিশ্চুপ রহস্যজনকভাবে। এখনও মনে পড়লে হু হু করে কেঁদে উঠেন পূত্রশোকে কাতর শহীদুলের মা। কারও শান্তনাই যেন তার মনের দুঃখ কমাতে পারছে না। কিন্তু কিছুদিন আগে উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে অপহৃত হওয়া সৌরভ চাকমাকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তোড়জোড় অবাক করে স্থানীয় সকলকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে অপহরন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হলেও, এরকম তোড়জোড় খুব কমই হয়েছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বহু ব্যাবহারকারী প্রশ্ন তুলেছেন, কেবল মাত্র গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিরাই কি প্রশাসনের আনুকূল্য পাবেন? কিংবা দরিদ্র বা ‘অগুরুত্বপূর্ন’ বা বাঙালি হওয়ার কারনেই কি শহীদুল রয়ে গেছে প্রশাসনের নজরের বাইরে? নাকি পেছনে কাজ করছে অন্য কোন রহস্য, যার কারনে আজও শহীদুলের মা তার সন্তানের অন্তত লাশের খোঁজ জানার অধিকার পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন? আজ আমরা ফেসবুক থেকে কিছু নির্বাচিত মন্তব্য ও স্ট্যাটাস তুলে ধরব পাঠকের সামনে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাঙালি অধিকার আন্দোলন নামের ফেসবুক পেইজে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, “সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ারের জামাতা বলে ৫ দিনের মাথায় সৌরভ চাকমাকে উদ্ধার করল সেনাবাহিনী। কিন্তু আমাদের শহীদুল? তাকে আজও উদ্ধারে কোন অভিযান কেন করা হলো না? সে ছোট বলে? সে গরীব বলে? তার লাশটাও খুজে পাওয়া গেল না আজও।” নাজমুল আহসান লিখেছেন, "শহীদুলকে উদ্ধারে প্রথম থেকেই প্রশাসন গড়িমসি করছে। ব্যপারটি দুঃখজনক।" আল-আমিন ইমরান নামের একজন লিখেছেন, “আজ যদি শহিদুল ইসলাম নামটির পরিবর্তে শহিদুল চাকমা হতো তবে দেখতেন কতোমিডিয়ার বোবা কান্না... পাশাপাশি চেতনা ধরদীদের বুকফাটা আর্তনাদ। দুঃখের বিষয় নিঃস্পাপ এই শিশুটির জন্য কথা বলার কোন মানুষ আজ নাই।” গাজী সালাউদ্দীন লিখেছেন, “৫৪টি দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। অথচ চুড়ি পরে থাকা স্থানীয় প্রশাসন আজ অবধি উদ্ধার করতে পারেনি শিশুটিকে। হতদরিদ্র বাবা-মা আদৌ ফিরে পাবে তার সন্তানকে??” নাজিমুদ্দিন আহম্মেদ লিখেছেন, “পলিথিনের থলে দিয়ে মোড়ানো শহিদুলের নিজের হাতে তৈরি বল,বিভিন্ন রকম খেলনা,শার্ট প্যান্ট,জুতা সবই আছে শুধু শহিদুল নেই।” সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে বাঙালি সংগঠন গুলোর নিরবতা ও অসক্রিয়তা নিয়েও। রাফি পাটোয়ারী নামের একজন এ বিষয়ে লিখেছেন, “এই শহিদুলের পরিবর্তে যদি একটি উপজাতি চাকমা ছেলে অপহরন হতো তাহলে বুঝা যেত প্রতিবাদ কাকে বলে! আমরা বাঙালিরা কারো প্রতি কেউ দায়িত্বশীল না, যেমনটা উপজাতিরা তাদের একের প্রতি অন্যেরা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। একটা বাচ্চা ছেলে শহীদুল ৫৪ দিন নিখোজ! সবাই কেন চুপচাপ? কারো যেন কোন দায়িত্ব বা কর্তব্য নেই।” ওবায়দুল্লাহ আল মেহেদী লিখেছেন, “কই দেখলাম শহিদুলের ব্যাপারে ছাত্রপরিষদের আন্দোলন? সমঅধিকার আন্দোলন করেছে কোথায়? সবাইইতো একদম চুপচাপ। এভাবে কি বাঙ্গালীর অধিকার রক্ষা করতে পারবেন আপনারা? এভাবে কি তা সম্ভব? আর কোন ঘটনায় আন্দোলন জোরদার হবে আপনাদের? একটি শিশু ২ মাস নিখোঁজ থাকার চেয়েও বড় ঘটনা ঘটলে? এর চেয়ে আর বড় ঘটনা কি হতে পারে?”
Read more ...

বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৪

প্রেক্ষিত দীঘিনালা উপজেলা নির্বাচন : ইউপিডিএফ ও জেএসএস বিরোধীতা কি লোক দেখানো?

সদ্য সমাপ্ত খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা নির্বাচন শেষে একটি প্রশ্নই নির্বাচন বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে। নতুন সমীকরণ তৈরী করে নির্বাচনী সমঝোতার মাধ্যমে আসন ভাগাভাগি করে নিয়েছে ‘চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী’ পাহাড়ের দুই সশস্ত্র আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি। দীর্ঘ বহু বছর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক শাখা জনসংহতি সমিতির সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় বাংলাদেশ সরকার। পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবী পাশ কাটিয়ে ভিন্ন কায়দায় নিজেদের দাবী ঠিকই সেবার আদায় করে নিয়েছিল সন্তু লারমার শান্তিবাহিনী। কিন্তু বাঁধ সাধে জনসংহতির আরেক গ্রুপ। পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবী থেকে সরে না এসে তারা চুক্তির বিরোধীতা করে সৃষ্টি করে নতুন সংগঠন – ইউপিডিএফ। বর্তমানে এর নেতৃত্বে আছেন প্রসীত বিকাশ খীসা।

প্রথম দিকে বেশ কোণঠাসা থাকলেও, শক্তি সঞ্চয় করে ক্রমেই শক্তিশালী হতে শুরু করে ইউপিডিএফ। বর্তমানে সন্তু গ্রুপকে হটিয়ে খাগড়াছড়ির বেশিরভাগ এলাকা ও রাঙ্গামাটির বিশাল দুর্গম এলাকা তাদের দখলে। এই দখলবাজী কতটা জাতির স্বার্থে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারন বর্তমানে সম্পূর্ন চাঁদাবাজি সর্বস্ব এই দুটি দল প্রত্যহ পরস্পরের সাথে রক্তক্ষয়ী স্বশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। চাঁদাবাজি নিয়ে ও এলাকা দখলের নিত্য লড়াইয়ে ভাতৃঘাতি সংঘর্ষের খবর বহুবার শুনতে হয়েছে পাহাড়ের মানুষকে। এমনকি সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়েই দীঘিনালার বাবুছড়া ইউনিয়নে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন মিনু চাকমা ও সুদৃষ্টি চাকমা নামের দুজন ইউপিডিএফ কর্মী। ইউপিডিএফ এর দাবীতে ও নিহতদের পরিবারের দায়ী করা মামলায় খুনীদের শন্তু লারমার জেএসএস-এর কর্মী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এরই মাঝে সন্তু গ্রুপের বিরোধীতা করে জনসংহতি সমিতিতেই তৈরী হয়ে যায় নতুন ভাঙ্গনের। জেএসএস (এম এন লারমা) নামের নতুন গ্রুপের জন্ম হয়েছে সন্তু লারমার একক নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষিপ্ত সংস্কারপন্থীদের দ্বারা। কৌশলগত স্বার্থে এই নতুন গ্রুপকে পরিচর্যা করতে থাকে শন্তু গ্রুপের পূর্ব শত্রু ইউপিডিএফ। শত্রুর শত্রু- মিত্র নীততে একে অপরকে এতদিন ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ সহযোগীতাও করে তারা। কিন্তু সেই চিত্রও পালটে যায় এবারের নির্বাচনে।

দীঘিনালা উপজেলা নির্বাচনে ৬ জন উপজাতি ও তিন জন বাঙালি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ৬ জন উপজাতি প্রার্থীর মধ্যে নবকমল চাকমা ও চয়ন বিকাশ চাকমা ছিলেন যথাক্রমে ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত। দীঘিনালায় তাদেরই শক্ত অবস্থান হওয়ায় এখানে কয়েকবছর ধরে কোন নির্বাচনের প্রার্থী দিচ্ছে না জেএসএস (শন্তু) গ্রুপ। গত উপজেলা নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন সংস্কারপন্থী জেএসএস সমর্থিত ধর্মবীর চাকমা, হেরে গিয়েছিলেন ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রিয়দর্শী চাকমা। কিন্তু এবার বিজয়ী হন ইউপিডিএফ সমর্থিত নবকমল চাকমা, হেরে গেছেন জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত চয়নবিকাশ চাকমা।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে বিশ্বস্ত সূত্রের খবর অনুযায়ী, ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থীর জয়ের মূলে রয়েছে ইউপিডিএফ-এর সাথে তাদেরই ‘চিরশত্রু’ জেএসএস (শন্তু) এর সমঝোতা! নির্বাচনী ফলাফল পর্যবেক্ষনের পরও মিলেছে খবরের সত্যতা। তবে ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সন্তু) কেউই রাজী নয় এই খবরের সত্যতা স্বীকার করতে।

বস্তুত হিসাবটা এলাকা ও ভোটার সংখ্যার। দীঘিনালায় সন্তু গ্রুপের অবস্থান সক্ত না হলেও, দীঘিনালার বাবুছড়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত সীমান্তবর্তী নাড়াইছড়ি এবং নুনছড়ি ও জারুলছড়িতে অবস্থিত কেন্দ্র সমূহ ও ভোটারদের উপর রয়েছে সন্তু গ্রুপের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। বিপরীত অবস্থা রাঙ্গামাটি সদরে। রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় শন্তু গ্রুপের একক নিয়ন্ত্রন থাকলেও, সদর উপজেলার কুতুবছড়ি, সাপছড়ি ও বন্দুকভাঙ্গা এলাকায় সম্পূর্ন আধিপত্য ইউপিডিএফ-এর। দুই উপজেলায়ই একই সাথে নির্বাচন হওয়ায়, দুই শত্রু নির্বাচনী সখ্যতা তৈরী করে একে অপরের সাথে। রাঙ্গামাটি সদরে জেএসএস (শন্তু গ্রুপ) এর প্রার্থীকে নিজেদের আওতাধীন তিন ইউনিয়নের ভোট পাইয়ে দেয়ার নিশ্চয়তার বিনিময়ে, দীঘিনালার তিনটি কেন্দ্রের ভোট সন্তু গ্রুপ থেকে নিজেদের প্রার্থীদের পক্ষে আদায় করে নেয় ইউপিডিএফ।

গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও ইউপিডিএফ এর সভাপতি প্রসীত বিকাশ খীসা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কুজেন্দ্র লাল জিতলেও তার নিজের এলাকা দীঘিনালায় বেশি ভোট পেয়েছেন প্রসীত খীসা। আবার প্রসীত খীসা দীঘিনালায় সামগ্রিকভাবে বেশি ভোট পেলেও, জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন বাবুছড়ার নাড়াইছড়ি, জারুলছড়ি ও নুনছড়িতে নামেমাত্র ভোট পেয়েছেন। ইউপিডিএফ-কে সমর্থন না দিয়ে সেবার আওয়ামী লীগের কুজেন্দ্রলালকে সমর্থন দিয়েছিল জেএসএস (সন্তু)। নাড়াইছড়ি কেন্দ্রে ইউপিডিএফ সভাপতি মাত্র ৫৯ ভোট পেলেও, কুজেন্দ্রলাল পেয়েছিলেন ১০৪২ ভোট!

কিন্তু এবার নির্বাচনী সমঝোতা হওয়ায় জেএসএস’র (সন্তু) সমর্থনের ফলে ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী নব কমল চাকমা সেই একই কেন্দ্রে পেয়েছেন ১০৪৭ ভোট, আর সেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত আলহাজ্ব কাশেম পেয়েছেন মাত্র ১১ ভোট, সংস্কারপন্থী জেএসএস সমর্থিত চয়নবিকাশ পেয়েছেন মাত্র ২৪ ভোট! একই চিত্র জারুলছড়ি ও নুনছড়ি কেন্দ্রেও! এই তিনটি কেন্দ্র মিলিয়ে ইউপিডিএফ সমর্থিত নবকমল পেয়েছেন প্রায় ৩, ৩১৬ ভোট, আওয়ামী লীগ সমর্থিত আলহাজ্ব কাশেম পেয়েছেন ৪৭ ভোট, জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত চয়নবিকাশ পেয়েছেন সাকূল্যে ১৫৫ ভোট। যদিও নবকমল চাকমার ১২, ৮১২ ভোটের বিপরীতে আলহাজ্ব কাশেম ১০, ৪৫৩ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন, জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত চয়নবিকাশ পেয়েছেন ৯, ৭৫৮ ভোট। একই অবস্থা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর বেলায়ও।

গতবার হেরে যাওয়া ইউপিডিএফ সমর্থিত সুসময় চাকমা এবার এই তিনটি কেন্দ্রের একচেটিয়া ভোট নিজের দখলে নিয়ে জয় দখল করেছেন। গতবারের ভাইস চেয়ারম্যান জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত সুপ্রিয় চাকমা এবার হেরেছেন নতুন সমীকরনের গ্যাঁড়াকলে।

চিরশত্রু ইউপিডিএফ’কে এই সমর্থনের বিনিময়ে জেএসএস (সন্তু) পেয়েছে আরও বড় সুবিধা! রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা নির্বাচনে ইউপিডিএফ কোন প্রার্থী দেয়নি এবং নিজেদের অধীনে থাকা ইউনিয়ন তিনটির ভোট একচেটিয়া পেয়েছে জেএসএস (সন্তু) সমর্থিত প্রার্থী অরুণ কান্তি চাকমা। সাপছড়ি, কুতুবছড়ি ও বন্দুকভাঙ্গা এলাকার বিপুল ভোট পেয়ে সহজেই জয় পেয়েছেন অরুণ কান্তি চাকমা। অথচ গতবার নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মুছা মাতব্বর।

ইউপিডিএফ ও জেএসএস (শন্তু) উভয়ই অস্বীকার করেছে কোন ধরণের নির্বাচনী সমঝোতার। ইউপিডিএফ-এর দীঘিনালা উপজেলা সংগঠক কিশোর ত্রিপুরা ও জেএসএস (সন্তু) এর সহ-তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা উভয়েই উড়িয়ে দিয়েছেন সমঝোতার খবর। সমঝোতার পর অস্বীকার – এমন লুকোচুরি লুকোচুরি গল্পের পর প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি ইউপিডিএফ আর সন্তু গ্রুপের বিরোধীতা লোক দেখানো? নির্বাচনে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের বেলায় তারা এক হতে পারলেও, নিজেদের মধ্যে ভাতৃঘাতি লড়াই বন্ধ করতে তারা এক হতে পারে না বলে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে সাধারন পাহাড়িদের মনে। বরং এ লড়াইকে জিইয়ে রেখে এলাকায় আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রেখে চাঁদাবাজি দখলদারিত্ব বজায় রাখতেই যেন তারা অধিক আগ্রহী।
Read more ...

আমার প্রথম ব্লগ পোস্ট

বন্ধু নাজমুল আহসান - এর পরামর্শে অবশেষে ব্লগ খুলেই ফেললাম! ধন্যবাদ তাকে। আশা করি নিয়মিত পোস্ট করব বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।

আমি আল আমিন, সাংবাদিক। আছি খাগড়াছড়িতে।
Read more ...