মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৪

নিখোঁজ শহীদুলকে নিয়ে সাইবার দুনিয়ায় তোলপাড়

অপহৃত শহীদুল ; ফাইল ফটো
শহীদুল! ফুটফুটে এক বাঙালি শিশু। সে আজ প্রায় দুই মাস ধরে নিখোঁজ। পরিবারের অভিযোগ, তাকে অপহরন করেছে উপজাতি স্বশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ। গত কিছুদিন আগেও নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার মত আরেকটি অপহরনের ঘটনা ঘটেছে পাহাড়ে। তবে এটি ছিল ‘হাই-প্রোফাইল’ অপহরন। উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে অপহৃত হয়েছিল উপজাতি সংগীত শিল্পী সৌরভ চাকমা টিনটিন ও তার বন্ধু। কিন্তু ৫ দিনের মাথায় তাদের উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। উল্লেখ্য, সৌরভ চাকমা পার্বত্য অঞ্চলের বেশ নামজাদা পরিবারের সন্তান। তার বাবা পিডিবি’র চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাবেক প্রধান, তার শ্বশুর তুষার কান্তি চাকমা সেনাবাহিনীতে কর্মরত একজন ব্রিগেডিয়ার, তার চাচা জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি’র সহ-প্রজেক্ট ডিরেক্টর ও রাঙামাটির অন্যতম ধর্ণাঢ্য ব্যাক্তি, তিনি চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের আগের স্ত্রীর ভাই। সুতরাং এত গুরুত্বপূর্ন পরিবার সমূহের আত্নীয় এই গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তি ও তার বন্ধুকে ৫ দিনের মাথায় উদ্ধার করে ফেলে সেনাবাহিনী। সাইবার দুনিয়ায় তোলপাড় এ নিয়ে। সবার প্রশ্ন, সৌরভ চাকমা ও তার বন্ধুকে ৫ দিনের মাথায় উদ্ধার করা গেলেও, ২ মাস আগে খাগড়াছড়ির পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে অপহৃত হওয়া দরিদ্র পরিবারের সন্তান শিশু শহীদুলকে উদ্ধারে কোন পদক্ষেপ কেন নেওয়া হচ্ছে না, এমনকি তার অপহরন রহস্যের কোন কিনারা কেন হচ্ছে না?

ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাকঃ ঘটনার শুরু খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে নিহত সবিতা চাকমা নামের এক উপজাতি নারীকে নিয়ে।
সবিতা চাকমার লাশ কমলছড়ির চর এলাকার সবজিক্ষেত থেকে উদ্ধার করা হয়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারী তিনি নিহত হন। তিনি কেন নিহত হয়েছেন, এটা নিয়ে আজও ধোঁয়াশা থাকলেও, সবসময়ের মত উপজাতি সংগঠনগুলো প্রথম থেকেই একতরফাভাবে দোষ দিতে থাকে বাঙালিদের। এক্ষেত্রে তারা দায়ী করে কোন একটি যানবাহনের বাঙালি হেলপারকে, যে না কি ধর্ষন করে খুন করে রেখে যায় সবিতাকে। যদিও সবিতা চাকমা যেখানে নিহত হয়েছেন, সেটি সম্পূর্ণই পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকা এবং নিকটস্থ সড়ক থেকে বহু দূরে। ময়নাতদন্তে বের হয়ে যায় গোমর। ময়নাতদন্তে রিপোর্টে দেখা যায়, সবিতা চাকমাকে ধর্ষন করা হয়নি, তার তখন পিরিয়ড চলছিল, তাই অতিরিক্ত পোষাক যথাস্থানেই ছিল। এ নিয়ে পার্বত্য নিউজেই সর্বপ্রথম সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এদিকে তখনও বাঙালিদের দায়ী করে সর্বত্র মিছিল মিটিং অব্যাহত রেখেছিল পাহাড়ি বিভিন্ন সংগঠন। পাহাড়ি স্বশস্ত্র ও অনিবন্ধিত সংগঠন ইউপিডিএফ পাহাড়ের প্রত্যেকটি উপজেলায় এ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। এমনকি শাহবাগেও তারা মানববন্ধন করে। তখন এগিয়ে আসে বাঙালি সংগঠন বাঙালি ছাত্রপরিষদ। তারা সবিতা চাকমাকে হত্যার পেছনে বাঙালিদের দায়ী করার প্রতিবাদে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি সদরে আয়োজন করে মানববন্ধনের। কিন্তু মানববন্ধন করে ফেরার পথে বেশ কয়েকজন নিরীহ বাঙালিকে অতর্কিতে হামলা করে পাহাড়ি উগ্র যুবকেরা। এতে ঘটনাস্থলেই বেশ কয়েকজন বাঙালি গুরুতর আহত হয়। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে আক্রমনাত্নক হয়ে উঠে স্থানীয় বাঙালিরাও। কিন্তু প্রশাসন ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের অনুরোধে শান্ত থাকে তারা। কিন্তু হঠাৎ করেই খবর বের হয় বাঙালি শিশু শহীদুলকে অপহরন করেছে
শহীদুলকে খুজতে গেলে আহত ৮ বাঙালির চারজন
ইউপিডিএফ। গুটিকয়েক কিছু বাঙালি শহীদুলকে খুঁজতে পাহাড়ি এলাকায় গেলে সেখানে সহযোগীতা না করে, উল্টো সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়া হয়। একজন বাঙালির চোখ উপড়ে ফেলে, অপর আরেকজনের রগ কেটে দেওয়া হয়। তখন ‘Jummaland’ ‘cht voice’ নামের কিছু ফেইসবুক পেইজ রটানো হয়, বাঙালিরা পাহাড়িদের বাড়িতে হামলা করতে এসেছে। একইসাথে উস্কানি দেয়া হয় পাহাড়িদের। সিএইচটি কমিশন সহ বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন সবিতা চাকমাকে নিয়ে বিবৃতি দিলেও, অপহৃত শিশু শহীদুলকে নিয়ে আজও কোন বিবৃতি দেয়ার প্রয়োজনটুকু মনে করেনি। ঘটনার পরপর সেনাবাহিনী, পুলিশ শহীদুলের পরিবারকে তাকে উদ্ধারের আশ্বাস দিলেও আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি কোন আশ্বাস। এমনকি নামেমাত্র মামলা নেওয়া হয় অপহরনের ১৫ দিন পর। কোন ধরণের সিরিয়াস অভিযান পরিচালনা করা হয়নি আজও। ঘটনার সাথে জড়িত রুবেল চাকমা, বিজ্জুকা চাকমা, মিন্টু চাকমারা আছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শহীদুল মরে গেছে না বেঁচে আছে, কেউই জানে না খবর।

সৌরভ চাকমা বনাম শহীদুলঃ অপহরন হওয়ার প্রায় ২ মাস অতিক্রান্ত হলেও আজও কোন ধরণের খোঁজ মেলেনি শহীদুলের। প্রশাসন নিশ্চুপ রহস্যজনকভাবে। এখনও মনে পড়লে হু হু করে কেঁদে উঠেন পূত্রশোকে কাতর শহীদুলের মা। কারও শান্তনাই যেন তার মনের দুঃখ কমাতে পারছে না। কিন্তু কিছুদিন আগে উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে অপহৃত হওয়া সৌরভ চাকমাকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তোড়জোড় অবাক করে স্থানীয় সকলকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে অপহরন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হলেও, এরকম তোড়জোড় খুব কমই হয়েছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বহু ব্যাবহারকারী প্রশ্ন তুলেছেন, কেবল মাত্র গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিরাই কি প্রশাসনের আনুকূল্য পাবেন? কিংবা দরিদ্র বা ‘অগুরুত্বপূর্ন’ বা বাঙালি হওয়ার কারনেই কি শহীদুল রয়ে গেছে প্রশাসনের নজরের বাইরে? নাকি পেছনে কাজ করছে অন্য কোন রহস্য, যার কারনে আজও শহীদুলের মা তার সন্তানের অন্তত লাশের খোঁজ জানার অধিকার পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন? আজ আমরা ফেসবুক থেকে কিছু নির্বাচিত মন্তব্য ও স্ট্যাটাস তুলে ধরব পাঠকের সামনে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাঙালি অধিকার আন্দোলন নামের ফেসবুক পেইজে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, “সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ারের জামাতা বলে ৫ দিনের মাথায় সৌরভ চাকমাকে উদ্ধার করল সেনাবাহিনী। কিন্তু আমাদের শহীদুল? তাকে আজও উদ্ধারে কোন অভিযান কেন করা হলো না? সে ছোট বলে? সে গরীব বলে? তার লাশটাও খুজে পাওয়া গেল না আজও।” নাজমুল আহসান লিখেছেন, "শহীদুলকে উদ্ধারে প্রথম থেকেই প্রশাসন গড়িমসি করছে। ব্যপারটি দুঃখজনক।" আল-আমিন ইমরান নামের একজন লিখেছেন, “আজ যদি শহিদুল ইসলাম নামটির পরিবর্তে শহিদুল চাকমা হতো তবে দেখতেন কতোমিডিয়ার বোবা কান্না... পাশাপাশি চেতনা ধরদীদের বুকফাটা আর্তনাদ। দুঃখের বিষয় নিঃস্পাপ এই শিশুটির জন্য কথা বলার কোন মানুষ আজ নাই।” গাজী সালাউদ্দীন লিখেছেন, “৫৪টি দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। অথচ চুড়ি পরে থাকা স্থানীয় প্রশাসন আজ অবধি উদ্ধার করতে পারেনি শিশুটিকে। হতদরিদ্র বাবা-মা আদৌ ফিরে পাবে তার সন্তানকে??” নাজিমুদ্দিন আহম্মেদ লিখেছেন, “পলিথিনের থলে দিয়ে মোড়ানো শহিদুলের নিজের হাতে তৈরি বল,বিভিন্ন রকম খেলনা,শার্ট প্যান্ট,জুতা সবই আছে শুধু শহিদুল নেই।” সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে বাঙালি সংগঠন গুলোর নিরবতা ও অসক্রিয়তা নিয়েও। রাফি পাটোয়ারী নামের একজন এ বিষয়ে লিখেছেন, “এই শহিদুলের পরিবর্তে যদি একটি উপজাতি চাকমা ছেলে অপহরন হতো তাহলে বুঝা যেত প্রতিবাদ কাকে বলে! আমরা বাঙালিরা কারো প্রতি কেউ দায়িত্বশীল না, যেমনটা উপজাতিরা তাদের একের প্রতি অন্যেরা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। একটা বাচ্চা ছেলে শহীদুল ৫৪ দিন নিখোজ! সবাই কেন চুপচাপ? কারো যেন কোন দায়িত্ব বা কর্তব্য নেই।” ওবায়দুল্লাহ আল মেহেদী লিখেছেন, “কই দেখলাম শহিদুলের ব্যাপারে ছাত্রপরিষদের আন্দোলন? সমঅধিকার আন্দোলন করেছে কোথায়? সবাইইতো একদম চুপচাপ। এভাবে কি বাঙ্গালীর অধিকার রক্ষা করতে পারবেন আপনারা? এভাবে কি তা সম্ভব? আর কোন ঘটনায় আন্দোলন জোরদার হবে আপনাদের? একটি শিশু ২ মাস নিখোঁজ থাকার চেয়েও বড় ঘটনা ঘটলে? এর চেয়ে আর বড় ঘটনা কি হতে পারে?”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন